করোনাকালে আলোচনার বড় অংশজুড়েই অক্সিজেনসংকট। সাম্প্রতিককালে ভারতের কয়েকটি শহরে অক্সিজেনসংকটের চিত্র বিশ্ববাসীকে স্তম্ভিত করেছে। আমাদের দেশেও আমরা নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) সঙ্গে সঙ্গে অক্সিজেনের সংকট দেখেছি। অথচ কী আশ্চর্য বাতাসের ৫ ভাগের ১ ভাগই কিন্তু অক্সিজেন। কিন্তু করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা সেই অক্সিজেন গ্রহণ করতে পারেন না বা পারলেও সেটি প্রয়োজনের চেয়ে কম হয়ে যায়। তখন তাকে দিতে হয় মেডিকেল অক্সিজেন। আর এই অক্সিজেন তৈরি হয় অক্সিজেন কারখানায়। কিন্তু যদি বাতাসের অক্সিজেনের ঘনত্ব বাড়িয়ে নেওয়া যেত তাহলে হয়তো কাজটা সহজ হতো।
গত বছর করোনা সংক্রমণের সময় ঠিক এমনটি চিন্তা করেছেন দেশে-বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ১৯৮২ সালের কয়েকজন স্নাতক প্রকৌশলী। ‘খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম এ ধরনের বহনযোগ্য অক্সিজেন কনসেনট্রেটর নতুন নয়। চীনসহ বিভিন্ন দেশে এটি তৈরি হয়। বাংলাদেশেও এগুলো কিনতে পাওয়া যায় ৫০ থেকে ৮০ হাজার টাকায়।’ জানালেন সেই ব্যাচের প্রকৌশলী বুয়েটের অধ্যাপক লুৎফুল কবীর। তিনি আরও বললেন, ‘আমরা ভাবলাম এই বহনযোগ্য কনসেনট্রেটর যদি দেশে বানানো যায় তাহলে কেবল সাশ্রয়ী মূল্যে নয় একই সঙ্গে বিভিন্ন চাহিদার কনসেনট্রেটর দেশেই বানানো সম্ভব হবে।’
সেই লক্ষ্যে বাংলাদেশ, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও সিঙ্গাপুরে অবস্থানরত বুয়েট ’৮২ ব্যাচের সতীর্থরা উদ্যোগ নেন এবং তাঁদের অর্থায়নে দেশীয় ডিজাইনে এটির একটি প্রোটোটাইপ তৈরি করেন।
প্রথম আলো থেকে সংগ্রহকৃত
মোহাম্মদপুরের একটি কারখানায় দুজন প্রকৌশলীকে নিয়ে অধ্যাপক লুৎফুল কবীর ও সতীর্থ ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের অধ্যাপক শামসুজ্জামান ফারুকের যৌথ নেতৃত্বে তৈরি হয়েছে বহনযোগ্য অক্সিজেন কনসেনট্রেটর অক্সিএনলাইফ। আন্তর্জাতিক মান সংস্থা আইএসও ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সব ব্যবহারবিধি ও নির্দেশিকা অনুসরণ করে এর নকশা তৈরি করা হয়েছে। যন্ত্রটি ৩৪০ ওয়াট বিদ্যুৎ শক্তি ব্যবহার করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্ধারিত অক্সিজেনপ্রবাহ (৮২ শতাংশের ওপরে বিশুদ্ধতাসম্পন্ন) নিশ্চিত করে।
অধ্যাপক লুৎফুল কবীর জানান, ‘এই প্রযুক্তিটির মূল বিষয়টি হলো, যন্ত্রটি বাতাস গ্রহণ করে ও বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এর ভেতর অবস্থিত বিশেষ রাসায়নিক বাতাসের নাইট্রোজেনকে শোষণ করে অক্সিজেনকে আলাদা করে ফেলে। এর ফলে যন্ত্রের ভেতরে অক্সিজেনের ঘনত্ব বেড়ে ৯০-৯৫ শতাংশে উন্নীত হয়, যা মানবদেহে দেওয়া যায়।’
যন্ত্রটিতে ব্যবহৃত রাসায়নিক যুক্তরাষ্ট্র থেকে আনা হয়েছে। তা ছাড়া এতে সংযোজিত হয়েছে নিজেদের তৈরি নিয়ন্ত্রণ (কন্ট্রোল) ও তদারকের (মনিটরিং) ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে অক্সিজেন ঘনত্ব থেকে শুরু করে তাপমাত্রা, ফ্লো-রেট সবই সার্বক্ষণিকভাবে পর্যবেক্ষণ করা যায়। যেহেতু এটি হাসপাতালে ব্যবহার করা হবে, সে জন্য শব্দশোষক ব্যবহার করে চালু অবস্থায় শব্দের পরিমাণ গ্রহণযোগ্য মাত্রায় রাখা হয়েছে।
এ ছাড়া তাৎক্ষণিক বিদ্যুৎ (আইপিএস) সংযোগের সুযোগ রাখা হয়েছে, যেন দেশের যেকোনো গ্রামে বিদ্যুৎপ্রবাহের অনুপস্থিতেও এটি ব্যবহার করা যায়। টানা ২৪ ঘণ্টা যন্ত্রটি চালিয়ে রেখে অক্সিজেনের ঘনত্ব ও প্রবাহ (ফ্লো-রেট) অপরিবর্তিত পাওয়া গেছে। তিনটি প্রোটোটাইপ তৈরি করে সেগুলোর বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাদি সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।অধ্যাপক লুৎফুল কবীর জানান, ‘আমাদের নিজেদের পক্ষে এই যন্ত্রের বাণিজ্যিক উৎপাদন সম্ভব নয়। দেশীয় কোনো উদ্যোক্তা বা প্রতিষ্ঠান যদি এটির বাণিজ্যিক উৎপাদন করতে চায় তাহলে আমরা তাদের কারিগরি সহায়তা দিয়ে সম্পূর্ণ সহযোগিতা করতে পারি।’ তিনি আরও জানালেন, ‘খবর জেনে দুটি ভারতীয় প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। কিন্তু আমরা আসলে দেশীয় প্রতিষ্ঠান বা উদ্যোক্তা খুঁজছি। এতে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও এটি ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হবে। এ ছাড়া করোনার প্রকোপ কমে যাওয়ার পরও শ্বাসকষ্টের রোগীদের জন্য এটির ব্যবহার অব্যাহত থাকবে।’
বহনযোগ্য অক্সিএনলাইফের বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করার পর আরও বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন অক্সিজেন কনসেনট্রেটর দেশে তৈরি করার জন্য কাজ করতে চান বুয়েট ’৮২-এর প্রকৌশলীরা। এর জন্য প্রয়োজন গবেষণা বরাদ্দ।